Bengali, Short Story

একটি ছবি।

দিনাজপুরের ছোট্ট শহরে আমি বড় হয়েছি । আমার মলিন কাপড়, সরু কালো আঙুল, ক্ষুধা ক্লিষ্ট আনত শরীর কোন কিছুই বড় শহরের উপযোগী নয় । তবু ক্লাস সেভেনে ভাল ফল হয়েছিল বলে আমার ফুপু ঢাকায় নিয়ে এলেন ভাল স্কুলে পড়ার জন্য। আমার অভিজ্ঞতা কম হলেও আমি এটুকু জানি, বড় শহর আমাকে আরো ছোট করে দেবে । বড় হতে সাহায্য যতটুকু করবে বাধা দেবে তার চেয়ে বেশি। জেনেও হৃদয়হীন এই শহরে অবহেলিত হতে চলে এলাম। এবং ষোলআনা অভিজ্ঞতা আদায় করে নিলাম। এই অভিজ্ঞতা আমার বড় হবার পথে কি কি কাজে লাগবে জানিনা, নিজের আত্মবিশ্বাসের বারোটা বাজাতে এটি খুবই সাহায্য করতে লাগল।

প্রথম কয়েক মাস ফুপুর বাসায় থাকলাম, তারপর আমার জন্য বোর্ডিং স্কুলের ব্যবস্থা করা হলো। ফুপাজানের বদলির চাকুরি, যদি হঠাত বদলি হয়ে যায় আমি কোথায় থাকব তাই নিয়ে কিছুদিন গবেষণার পর আমাকে বোর্ডিং স্কুলে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হল । আমার জন্য এটা বেশ সুখকর মনে হতে লাগল । এর মানে হচ্ছে ঢাকায় যাদের বাড়ি নেই তারাই বোর্ডি স্কুলে থাকে, আমিও তাদের একজন। ফার্মের মুরগি ঢাকাই ছেলেগুলো আসলে শয়তানের ঝাড় । শহরে থাকলেও মানসিকতা খুব উন্নত নয়। কথায় কথায় নালিশ করে, অশ্লিল গালি দেয়, অন্যের টিফিন খায়, ধরা পড়লে খ্যাক খ্যাক করে হাসে। লজ্জাও বোধ করি কম । তাছাড়াও বিশেষ একধরনের হৃদয়হীনতা আছে যা বোধ করি শহরের পয়সাওয়ালাদের পৈত্রিক সম্পত্তি।

আমার ফুপুর পোষ্টিং হলো না, তারা গিয়ে নিজেদের দামি ফ্ল্যাটে উঠলেন। সেখানে শুক্র-শনিবার আমার যাবার অনুমতি ছিল । হাউজিং কমপ্লেক্স গুলো সুন্দর সুন্দর কম্পিউটার গ্রাফিক্স দেখিয়ে ফ্ল্যাট বিক্রি করে। অটোক্যাডে স্পেসের সর্বোচ্চ ব্যবহার করে পরে যা দেয়া হয় সেটি কিমভূত ছায়া মাত্র। সুতরাং খোলামেলা প্রকৃতির কোল ঘেষে যে বাড়ি থাকার কথা বাস্তবে সেখানে একবাড়ি অন্যবাড়ির কোল ঘেঁষে পরম আত্মিয়ের মত থাকে । প্রাইভেসি বলে জিনিষটি পর্দার উপর দিয়ে চালিয়ে দেয়া হয়। সে পর্দা কখনই খোলা হয় না, দিনের বেলা বাতি জ্বালিয়ে বসে থাকতে হয়।

আমি ছুটিতে এলে যে ঘরটায় থাকতাম সে ঘরটার জানালার পাশে আরেক বাসার বারান্দা। আমি গ্রামের ছেলে এত পর্দায় আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হবার জোগাড়। আমি ঠিক করেছি পর্দা সরিয়ে রাখব। কিন্তু আরেক বাসার বারান্দায় চোখ পরাটা ক্যামন যেন দৃষ্টি কটু লাগল। সকালে আমি দেরি করে ঘুম থেকে উঠি, সেদিন সকাল নয়টায় আমার ফুপাত ভাই নয়ন কর্ডলেস ফোন নিয়ে এসে বলল ভাইয়া তোমার ফোন। যে কালের কথা বলছি সে কালে ফোন ছিল গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের জন্য। বাসায় ফোন থাকাটা স্ট্যাটাসের সী্মারেখা উত্তির্ণ। আমি কতখানি অ-গুরুত্বপূর্ণ তাতো আর বোঝার বাকি নেই আপনাদের। আমি ইতস্তত করতে করতে ফোন নিলাম। জানিনা কি করে কথা বলতে হয়।

-হ্যালো?

-কি ঘুম ভাংলো? এত ঘুমালে শরীর খারাপ করবে যে, উঠে পরেন পরে আবার ফোন করবো। কিশোরীর অসম্ভব মিষ্টি কন্ঠ।

– আমি ফোন ধরে হতভম্ব হয়ে বসে আছি। ফোনের ভেতরে পি পি আওয়াজ। নয়নের চোখে দুষ্টুমি হাসি। আমি বললাম ‘মেয়েটা কে রে?’ নয়ন এবার রহস্যময় হাসি হেসে বলল ‘বড় আপু’।

আমি আরো অবাক হয়ে বললাম তোর বড় আপু এলো কোথা থেকে? স্মিত হেসে ‘আছে’।

এরপর অমোঘ প্রশ্নটি ‘দেখতে ক্যামন?’, নয়ন এবার উচ্চস্বরে হেসে ‘বলা যাবেনা’।

আমি বিরক্ত হয়ে বললাম ‘বলা যাবে না ক্যানো?’ ‘নিষেধ আছে’।

আমি বিস্মিত হয়ে জানতে চাই ‘কার নিষেধ আছে’? ‘বড় আপুর’

-মানে? আমার চোখ কপালে।

– আপু বলেছে তোর ভাইয়া অবশ্যই জানতে চাইবে, আমি দেখতে ক্যামন ‘তুই বলবি না’।

আমি অবাক হয়ে বললাম ‘তোর আপু জানতো আমি এই প্রশ্ন করবো?’

-হ্যাঁ।

-কি করে জানতো?

-আপু অনেক কিছু জানে। মুখে শ্রদ্ধার ভাব।

-তাহলে তুই বলবি না?

– না।

আমি স্বপ্নে বিভোর একজন মানুষের মত বাথরুমে গেলাম, টুথ ব্রাশ করলাম, টুকিটাকি কত কি । কিন্তু মন পড়ে রইল টেলিফোনে । আহ এত সুন্দর হয় মানুষের কণ্ঠ! আমাকে সে চিনবে কি করে? আমাকে সে ফোন করবে ক্যানো?

নাশতার কোন স্বাদ পেলামনা। কি খেয়েছি তাও বলতে পারবোনা । নয়নকে কিছু জিজ্ঞাসা করে লাভ নেই। কিছু জানতে চাইলে হাসে, আর বলে আপু কোন কিছু বলতে নিষেধ করেছে ! নয়ন আমার একজন একনিষ্ঠ ভক্ত আমার চেয়েও বেশি ভক্তি এই নতুন আপু’র প্রতি, আমার মনটা একটু খারাপ হল।

আবার ফোন এসেছে একঘন্টা বাদে। সে তার নাম বলল, তারা তিন বোন সেটা জানলাম, আমি আর সে একই ক্লাসে পড়ি ইত্যাদি ইত্যাদি। ফোনে কথা বলার প্রচুর অভ্যাস আছে, আমি অভ্যাসকে স্মার্টনেস ভেবে নিয়ে আরো কুন্ঠিত হয়ে রইলাম। সুকন্ঠির কথাবার্তায় মুগ্ধ। সমস্যা হল এই বয়সে সব মেয়েকেই অসাধারণ লাগে। এমন কোন বয়স কি আছে যখন সব মেয়েদের সাধারণ লাগে! আমি জানিনা আমার বোধ হয় সে বয়েস এখনও হয়নি।

গরমের দিন। দুপুরে সবাই যখন দিবা নিদ্রারত আমি জানালার পর্দা সরিয়ে একটা বই পড়তে লাগলাম। হটাত সেখানে বাচ্চা একটি মেয়ে গ্রিল ধরে আমাকে কিছু একটা বলল, আমি তাকাতেই সরে গেল। পর্দা টেনে দেয়া উচিত কিনা চিন্তা করতে করতেই সে আবার এল, জানতে চাইল ‘কি বই পড়ছেন?’ আমি বইটার নাম বললাম। সে চলে গেল, ফেরত এল কিছুক্ষণ বাদেই ‘আপনি কি কাউকে ভালোবাসেন?’ আমি বললাম ‘মানে’? সে চলে গেল আবার এসে, ‘খুব ভাব নিচ্ছেন না?’ এভাবে বেশিক্ষণ কথা চালান কঠিন। আমি বললাম তোমাকে যিনি শিখিয়ে দিচ্ছে তাকে আসতে বলো।

এবার দ্বিতীয় একটি মেয়ে এল । সে এসে আমাকে বলল । ও ও বড় আপুকে দেখতে ইচ্ছে করছে? আমি বললাম ‘হ্যাঁ তোমার ভীতু আপুটাকে সামনে আসতে বলো’ ।

একটি দমবন্ধ করা রূপবতী মেয়ে এসে সামনে দাড়াল, ‘আমি ভীতু নই’ ।

ভীতু আপনি, একটি মেয়ের সাথে টেলিফোনে কথা বলতে পারেন না!’

আমি কিছু বলার আগেই সে সরে গেল।

তারপর অনেক কিছু ; আমি পালিয়ে পালিয়ে থাকি, সে সামনে সামনে দুষ্টামি করে বেড়ায়। মাঝে মাঝে আত্মসচেতন হয়ে গম্ভীর হয়ে যায় আবার যেই সেই। একদিন আমি একটা বই পড়ছিলাম সেই বইটা তার লাগবেই, রূপবতী মেয়েদের কাছে হার মানতে হয় এটাই নিয়ম। রাতে শুয়েছি, আমার লাইট বন্ধ করার পর ঐ পাশের আলো এসে জানালায় পড়লো। ওপাশে তখনও লাইট জ্বলছে। আমি কৌতূহলী হয়ে পর্দা সরালাম, দেখি মেঝের উপর বসে সে সেই বইটা পড়ছে । তারও জানালার পর্দা সরানো, ঠিক বারান্দার উপর রুমটি এখন তার দখলে।

বইটা সেবা প্রকাশনীর, একটা জাহাজ ডুবির গল্প। লেখক খুব ইচ্ছে করে সেখানে একটি কিশোরী মেয়ের সঙ্গে একটি কেবিন বয়ের একটা আদি রসাত্মক ব্যাপার ঢুকিয়ে বইটির আকর্ষণ বাড়ানোর চেষ্টা করেছেন। তখনকার সেবা প্রকাশনীর বইতে এটা নৈমিত্তিক ছিল। বুঝলাম মেয়েটি সেই অংশটি পড়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে, এত হাসির কি হল কে জানে। আমি চার / পাঁচ বারের চেষ্টায় বলতে পারলাম ‘ও বই পড়া হচ্ছে’?

মেয়েটি ইলেক্ট্রিক শক খাওয়ার মত লাফিয়ে উঠে লাইট অফ করে দিলো। আমি মেয়েটি অপমানিত হয়েছে ধরে নিয়ে জানালা থেকে দূরে এসে দাঁড়ালাম যেখান থেকে সে আমাকে দেখতে না পায়। এবার সে এসে জানালায় দাড়াল, একপাক বারান্দা দিয়ে ঘুরে গেল । ছেলেদের একটা পর্যায়ে সাহসী হতে হয়, আমি পারিনা । এ কারণে আমাকে একজন নাম দিয়েছিল ডিসেন্ট ডিজাস্টার। শুনতে ভাল শুনালেও এটা ভয়াবহ অযোগ্যতা।

আমি চুপচাপ এসে বিছানায় শুয়ে পড়লাম।

পরের বার যখন এলাম স্কুল ২০ দিন ছুটি, কিন্তু আমাকে দিনাজপুর নিয়ে যাওয়ার বা নিয়ে আসার মত কাউকে পাওয়া গেল না। সুতরাং ফুপুর বাসাতেই কাটাতে হবে।

মেয়েটি আমাদের বাসার নাম দিয়েছে খেলাঘর। বাসায় সারাদিন খেলা চলে, দাবা, লুডু, বাগাডুলি, তাস, ক্যারাম, ব্যাডমিন্টন আরো কত কি! নাম যথার্ত হয়েছে। দিন ভালোই কেটেছিল, ফোনে কথা বলে আর খুনসুটি করে। ছাদে দেখা হলে সিঁড়িতে তিনবোন বসে থাকে আমি যেন না নামতে পারি, অসময়ে শুয়ে থাকলে কোথা থেকে পানির ঝাপ্টা এসে পড়ে, খাবার নিয়ে গড়িমসি করলে ফোন আসে। মিষ্টি একটা কন্ঠ কড়া ধমক লাগায়। এভাবে ভালোই কাটছিল। হটাত একদিন সব বন্ধ। আর তিনদিন পর আমি চলে যাব। মেয়েটির কোন দেখা নেই। রাগে, অভিমানে আমার মেজাজ যখন সপ্তমে আমি সেই বইটি ফেরত পেলাম, ভিতরের পেজ গুলো ছেঁড়া।

সেদিন আমি চলে যাব, গত তিনদিনের প্রচন্ড মানসিক কষ্ট নিয়ে এবং মেয়ে জাতিকে অনেক গালাগাল করে যাবার জন্য তৈরি হচ্ছি, বারবার চোখ চলে যাচ্ছে সেই বারান্দায়, কোথাও কেউ নেই। যাবার আগ মুহূর্তে জানতে পারলাম আর কোনদিন দেখা হবে না, ওরা অন্য কোন জায়গায় সেটল করবে । আমি মন খারাপ করে গাড়িতে উঠলাম, ঠিকানা চাইলাম না, গত তিনদিন যারা আমাকে ভুলে থাকল তাদের সাথে আমার কিসের সম্পর্ক? আমি কি তাদের খেলনা? খেলা শেষ, ঘরের এককোনে ফেলে রাখো তারপর একদিন জঞ্জাল মনে হলে ফেলে দাও অন্য ময়লার সাথে!

গাড়িতে গিয়ে উঠলাম, একদিকে ফুপু অন্যদিকে ফুপা । দুজনকেই বাঘের মত ভয় পাই। তারপরও গাড়ির পেছনের কাঁচ দিয়ে ফিরে তাকালাম, যাওয়ার আগে একনজর কি দেখা হবে না? এক রং বেগুনি জামা পড়ে সোনালী রঙের একটি মেয়ে একরাশ কালোচুল দুপাশ থেকে ঝুলিয়ে দিয়ে বারান্দায় ঝুঁকে দাঁড়িয়ে।

বিষন্ন, মলিন মুখখানি আনত, আমি এই দৃশ্যটিকে ভালোবেসে ফেললাম।

1 thought on “একটি ছবি।”

Leave a comment

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.